অন্যান্য প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জনপ্রিয় শুটিং স্পট - প্রীতম সাহা

নদী মাঠ অরণ্যে ঘেরা বাংলার ভৌগলিক রূপ বরাবর নজর কাড়ার মতো। ভোজনরসিক,ভ্রমণপিপাসু, সংস্কৃতি মনস্ক মানুষজনের প্রত্যেকেই বাংলার রূপ-রস-গন্ধে মজেছে প্রতিবার।আর তার সাক্ষী হয়ে থেকেছে অজস্র শিল্পকলা। সিনেমা বা চলচ্চিত্র তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পরিচালকদের গল্প বলার সূত্রে ফ্রেমবন্দি হয়েছে বাংলার জনপ্রিয় শুটিং স্পটগুলো। 

ঝাড়গ্রাম 

শাল শিমুল মহুয়ায় ঘেরা ঝাড়গ্রাম ফিল্ম-মেকারসদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ শুটিং স্পট।অনেক জনপ্রিয় বাংলা ছবির শুটিং হয়েছে এখানে।ঝাড়গ্রাম প্যালেস যার মধ্যে জনপ্রিয়।মহানায়কের ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবি থেকে শুরু করে সন্দীপ রায়ের ‘টিনটোরেটোর যীশু’ এবং সাম্প্রতিক অতীতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’ প্রায় প্রত্যেকেরই শুটিং লোকেশন এই ঐতিহাসিক প্যালেস।বেহুলা লখীন্দর' এ চাঁদ সওদাগরের প্রাসাদ ছিল ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। আর ভেলায় চড়ে যাওয়ার দৃশ্য হয় ঘাঘরাতে। কলাবনীর জঙ্গলেও ছবি তোলা হয়েছিল।১৯৫৯ সালে বিকাশ রায় পরিচালিত 'মরুতীর্থ হিংলাজ' সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শুটিং হয় ওদলচুয়ার কেটকি ঝর্না এলাকায়।


এছাড়া দহিজুড়ি থেকে কংসাবতী যাওয়ার সময় বসন্তপুরের কাছে এলাকাটি অনেকটাই মরুভূমির মতো। সেখানেও দৃশ্যায়ন হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া "পথের ক্লান্তি ভুলে, স্নেহ ভরা কোলে তব / মাগো, বলো কবে শীতল হবো / কত দূর, আর কত দূর, বলো মা / আঁধারের ভ্রুকুটিতে ভয় নাই / মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই / যদি এ পথ চলিতে কাঁটা বিঁধে পায় / হাসিমুখে সে বেদনা সবো / কত দূর আর কত দূর, বলো মা" গানটি দেখলেই বোঝা যাবে। সেসময় উত্তমকুমার, বিকাশ রায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়রা ঝাড়গ্রামে না থেকে ছিলেন ঘাটশীলাতে। সেখান থেকে এসে শুটিং করেছেন। এটাই ঝাড়গ্রামের বুকে প্রথম কোনও বাংলা ছায়াছবির শুটিং হয়েছিল। ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন স্থানে উত্তম কুমার অভিনীত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'দুই পুরুষ' এর কাহিনীতে সিনেমা বানিয়েছেন পরিচালক সুশীল মুখার্জি (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮)।

দার্জিলিং

শৈলশহর দার্জিলিং-ও সেলুলয়েডের ঘেরাটোপ থেকে বাদ যায় কেন?
দার্জিলিংয়ের পটভূমিকায় একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে।এক অর্থে দেখতে গেলে যার মুল আকর্ষণ দার্জিলিংই।সে বরফি ছবিতে বরফির সমস্ত দৌরাত্ম হোক কিম্বা কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্পই সবেতেই দার্জিলিং আর তার বুকভরা সৌন্দর্য মায়াজাল বিস্তার করে আছে।দার্জিলিংয়ের লক্ষণীয় কিছু শুটিং স্পটের মধ্যে রয়েছে ঘুম রেলওয়ে স্টেশন,চৌরাস্তা,সেন্ট পলস স্কুল।ম্যায় হু না ও জজ্ঞা জাসুস ছবির বেশ কিছু অংশের শুটিং হয়েছে এই স্কুলটিতে।


কলকাতা

শিল্প সংস্কৃতির পিঠোপিঠি অবস্থান যে শহরে,সেখানে ক্রিয়েটিভ মানুষজনের আনাগোনা হওয়াটা স্বাভাবিক।বহু পরিচালক তাঁদের ছবির গল্পে সেই এসেন্সটুকুকে ফুটিয়ে তোলবার জন্য বেছে নিয়েছে ‘দ্য সিটি অব জয়-‘কে ।যেমন সুশান্ত সিং রাজপুত অভিনীত ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সীর গল্পের খাতিরে পুরোনো কলকাতাকে রিক্রিয়েট করবার জন্য বো ব্যারাকে ছবির সিংহভাগ শুটিং করা হয়েছে।বুলেট রাজা ছবিতে সইফ আলি খানের রিক্সা টানার দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে উত্তর
কলকাতার বাজার এলাকায় ঐতিহ্যবাহী টানা রিক্সার দিকটি সিনেমার পর্দায় উঠে এসেছে।এছাড়া ভিক্টোরিয়া, রেসকোর্সের মাঠ, হাওড়া ব্রিজ শুটিং লোকেশন হিসেবে অনেকের কাছেই প্রেফারেবল ডেসটিনেশন।


মেদিনীপুর

মহিষাদল রাজবাড়ির ঐতিহ্যশালী লোকেশনে বহু ছায়াছবির শুটিং হয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুমিত্রা মুখার্জির 'দত্তা' সিনেমায় পালকিতে করে যাওয়ার দৃশ্য কিংবা সাম্প্রতিককালে রাজীব বিশ্বাস পরিচালিত ‘খোকা ৪২০' এর গান এখানেই চিত্রায়িত হয়েছে।এছাড়া বাংলাদেশের বিখ্যাত নায়ক সাকিব খান এবং অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চ্যাটার্জি অভিনীত জয়দীপ মুখার্জি ও জাকির হোসেন পরিচালিত 'শিকারী'র শুটিংও হয়েছিল এখানে। তমলুক রাজবাড়িতে হয়েছে পাহাড়ী সান্যাল ও লিলি চক্রবর্তী অভিনীত 'কেদার রাজা' সিনেমাটি। নারায়নগড়ের হাঁদলাগড় রাজবাড়ি ও মহিষাদল রাজবাড়িতেও শুটিং হয়েছে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা  'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'। এতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা রায়। এছাড়াও 'বাংলার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন' গড়বেতার গনগনিতে এটির শুটিং হয়। শুটিংয়ে এসেছিলেন আবির চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্তরা। 


মেদিনীপুরের কবি, গবেষক ও শিক্ষক সন্তু জানা এই ছায়াছবিতে অভিনয় করছেন। সম্প্রতি 'কিরণমালা' সিরিয়ালের শুটিং হয়েছিল গনগনিতে। বহুবছর আগে 'পান্না' সিনেমারও শুটিং হয়েছিল এখানে। এই সন্তু জানার বংশের এক অখ্যাত মহিলা সুধা জানা অভিনয় করেছিলেন পীযুষ বসু পরিচালিত উত্তমকুমারের 'ধনরাজ তামাং'য়ে (১৯৭৮)। নয়াগ্রামে আদি বাড়ি তাঁর। মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনাতেই গড়ে উঠেছে প্রয়াগ ফিল্ম সিটি। শাহরুখ খান এই ফিল্ম সিটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। এখানে শুটিং হয়েছিল দেবের 'যোদ্ধা' সিনেমাটি। এখন ফিল্ম সিটি অবশ্য সম্পূর্ণ বন্ধ।


দিঘা


সমুদ্র শহর দীঘাতে অজস্র সিনেমার শুটিং হয়েছে। ইয়ত্তা নেই সে সব। তবুও দাগ কেটে যায় উত্তম সুচিত্রা জুটির 'বিকেলে ভোরের ফুল'। সুমিত ভঞ্জ ও সুমিত্রা মুখার্জীর 'ঢেউ' এখানে হয়েছে। সুজিত মণ্ডল পরিচালিত দেব, শ্রাবন্তী অভিনীত ছায়াছবি 'সেদিন দেখা হয়েছিল' ( ২০১০) ছবির শুটিং হয়েছিলো এই  দীঘাতেই। 


বাংলার প্রকৃতি, ইতিহাস আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন শুধু সাহিত্যেই নয়, চলচ্চিত্রেও সমানভাবে ধরা দিয়েছে। ঝাড়গ্রামের অরণ্য, দার্জিলিংয়ের পাহাড়, কলকাতার নগরজীবন, মেদিনীপুরের রাজবাড়ি কিংবা দিঘার সমুদ্র, প্রতিটি জায়গাই পরিচালক ও দর্শকের কাছে নতুন গল্প বলার এক অমূল্য পটভূমি হয়ে উঠেছে বারবার। শুটিং স্পটের মাধ্যমে এই স্থানগুলো শুধু সিনেমার ফ্রেমেই নয়, দর্শকের হৃদয়েও জায়গা করে নিয়েছে। বলা যায়, বাংলার প্রতিটি প্রান্ত যেন এক একটি জীবন্ত চলচ্চিত্রের অধ্যায়, যেখানে প্রকৃতি আর সংস্কৃতি মিলে গড়ে তোলে এক অনন্য রূপকথার আবহ।

মন্তব্যসমূহ

সদস্যতা গ্রহণ করুন

Subscribe

* indicates required