শীত এসে গেল। ঘরে ঘরে বড়ি তৈরি শুরু। কত রকমের বড়ি। প্রধানত করাই ডালের বড়ি খুবই প্রচলিত। অবশ্য মুসুর ডালের বড়ি কম যায়না। মটর ডালও চলে। কত গুলি বিষয়ে বাঙালিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। যেমন গামছা, নকশিকাঁথা ,বড়ি, মাছের পাতুরি ইত্যাদি। ছোট বেলায় দেখতাম পর পর বাড়িতে যেন বড়ি দেওয়ার উৎসব লেগে যেত ছাদে ছাদে। বাড়িতে শুরু হত এক শুভ দিন দেখে আমার ঠাকুমার হাত দিয়ে। প্রথম সূর্যকিরণ আসার আগে সকলে স্নান সেরে পরিষ্কার কাপড়ে তৈরি থাকত। প্রথমে একটা বড় শুকনো থালার উপর তেল মাখিয়ে ,একদম মাথার সারিতে রাজা আর রানী,বেশ বড় আকারের ।তাকে দূর্বা ঘাস দিয়ে সাজানো থাকত। না জানি আর কি করা হত। তবে আমাদের ছেলেদের মাঝে মাঝে বকা খেতে হত রোদ্দুর আটকে দাঁড়াবার জন্য। বিভিন্ন ডালের, বিভিন্ন আকারের বড়ি। তবে ক্ষুদ্রতি ক্ষুদ্র ভাজা বড়ি তৈরি পৌঁছে গেছিল শিল্পের পর্যায়। এ কাজ সকলের আয়ত্তে ছিলনা।
তখন বিষয় টির প্রতি কোন গুরুত্ব না দিলেও, এখন বুঝি বিষয়টির মধ্যেও বিজ্ঞান আছে। একদিন একটা বিয়ের বাড়িতে ভিয়েন ঘরে বসে বসে দেখছিলাম বোনদে/বোঁদে কিভাবে তৈরি হয়। যে কারিগর কাজটি করছিল সে ব্যাসন বার বার ফেটানোর মাঝে মাঝে এক ফোঁটা করে, এক মগ ভর্তি জলের মধ্যে ফেলে কি যেন দেখছিল। মনে মনে একটা ধারণ করেছিলাম কিন্তু কারিগরকে আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি।পরে কর্মস্থল নামক "জ্ঞান ভাণ্ডারে' এক অতি পরিচিত কর্মীকে (মিষ্টান্ন কারিগর) কথায় কথায় বলেছিলাম। সে বিষয়টি সরলীকরণ করে দিল। জানতে পারলাম, ব্যাসন, জল ও বাতাস এমন ভাবে মেশাতে হবে যাতে ওই মিশ্রিত বস্তুটির এক বিন্দু জলে পড়া মাত্রই ভেসে উঠবে। যদি জলের নিচে চলে যায় বা উঠতে দেরি করে তাহলে আরও ফেটানো প্রক্রিয়া চালাতে হবে। মূল কথা যথাযথ পরিমান বাতাস প্রবেশ করাতেই হবে। ওদের ভাষায় ওই অবস্থাকে 'শেম শেম' বলে। এই শেম ইংরাজী শব্দ same বা shame কিনা যাচাই করা হয়নি।
ভাজার সময় আটকে থাকা বাতাস বেরিয়ে এক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বিশিষ্ট্য মৌচাক সদৃশ (honey comb structure) আকার দেবে যার মধ্যে পরে ঢুকবে চিনির রস। এটা কি কোন ভাবনার ফসল নয়?
এখন বুঝতে পারি মা ঠাকুমা বা কাকিমারা কেন গল্প করার নাম করে অনেক ক্ষন ধরে শুধু এই প্রক্রিয়াটি, অর্থাৎ বাতাস প্রবেশ করানো, সমাপন করত। শুধু তাই নয় বড়ি দেবার কালেও এই প্রক্রিয়াটি অবিরত চলতে থাকত।
বড়ি দেবার পাত্র হিসাবে কিছু বাদ যেতনা। এনামেল করা পাত্রই বেশি পছন্দের ছিল, সহজে শুকনো বড়ি খুলে আসার কারণে। অনেক সময় পরিষ্কার শুকনো কাপড় ব্যবহার হত।
বড়ি তৈরির সমস্যাও অনেক। যেমন ধরুন প্রায় শুকিয়ে এসেছে আর হটাৎ আকাশের মুখ ভার হল। সেক্ষত্রে বড়িতে একটু গন্ধ হয়। আমার এক আত্মীয়া তার বেশ একটা সমাধান করেছিল। তাদের বাড়িতে ফোটানো জল খাওয়ার প্রচলন ছিল। সে গরম জলের ঢাকার উপর প্রায় শুকনো বড়ি সারা রাত রেখে দিত। আসলে তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। এ সবই গল্প। আজ আর এই প্রজন্মের কেউ বোধ হয় বড়ি দেয় না। শুধু দোকান থেকে কেনা আর তৎপরবর্তী অভিযোগ।
বড়ি কথা আর টেনে লম্বা করবনা।" দেশ" পত্রিকায় ,অনেকদিন আগে পড়া একটা কথা দিয়ে শেষ করব। তখন , সাহিত্যিক আব্দুল জব্বার , "চালচিত্র" নামে এক পৃষ্ঠার ফিচার লিখতেন। তিনি কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানে বিজ্ঞাপনের বোর্ড দেখলেন। লেখা...এখানে মহিলাদের দ্বারা তৈরি উৎকৃষ্ট মানের সকল প্রকার বড়ি পাওয়া যায়। কৌতহলবসত, বড়ি তৈরির কারখানায় পৌঁছে দেখেন এক দল ষন্ড মার্কা গোঁফওয়ালা লোক পা দিয়ে ব্যাসন মাখামাখি করছে। বুঝতে দেরি হলনা কেন ওই বড়ি এত সুনাম কুড়িয়েছে।
বড়ার কথা আর কি লিখি? চূড়ো থাকলে বড়ি আর থ্যাবড়া হলে বড়া।


মন্তব্যসমূহ